1. info@www.media71bd.com : NEWS TV : NEWS TV
  2. info@www.media71bd.com : TV :
বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬ পূর্বাহ্ন

‘রুপক’ গানের ভেতর – বাহির

হাকিম, স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট
  • Update Time : বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

‘রুপক’ গানের ভেতর – বাহির

লেখকঃ আব্দুল করিম (জিয়ন)

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি,তখন তারে জানি।” মানবের চিরন্তন আকাঙ্খা ‘চেনা’ আর ‘জানা’। এই চেনা-জানার জন্য তিনি মাধ্যম বেছে নিয়েছেন গানকে। সত্যিই তো তা-ই। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই, বাঙালির সৃজনশীলতা বিকাশের যতগুলো শিল্পকলার শাখা আছে, তার মধ্যে গানই সেরা। গানের ভেতর দিয়ে। বাঙালির সৃষ্টিশীলতার ব্যাপক প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে। তাইতো দেখতে পাই, বিশ্বমঞ্চে Song Offerings শীর্ষক সঙ্গীত গ্রন্থে বাঙালী পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার যা পৃথিবীতে বিরল। কোন এক ইংরেজ লেখক যথার্থই বলেছিলেন, বাঙালী ভালোবাসে দু’টি জিনিস। গান আর ভারামি। আবাল-বৃদ্ধ-বগিতা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব সবাই তো ভালোবাসে গানকে, গানে ভুবন ভরা।

আমাদের বাংলা গানের উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে দুই-চারটি কথা বলা দরকার। আমরা জানি, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কিন্তু ধর্মীয় সংগীত, মানে গান। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায় বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত। চর্যাপদের অন্যতম কবি হলেন কাহ্নপা। তাহলে বলা যায়, বাংলা ভাষা শুরু হয়েছে বাংলা গান দিয়ে। শুধু কি তা-ই? চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, পুঁথি, কবিগান, টপ্পা, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ইত্যাদি সবই গান আবৃত্তি তথ্য পাঠের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম কবিতা রচনা করেন। তাহলে দাঁড়ালো, বাংলা ভাষার উৎপত্তি চর্যাপদ হতে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যত কবিতা হয়েছে, তার সব কিছুই গীতিকবিতা বা গান। আর সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথই আধুনিক বাংলা গান বা রবীন্দ্রসংগীত রচনা করেছেন। আর নজরুল দিয়েছেন আধুনিক বাংলা গানের বৈচিত্র্যময় রূপ। তার পরের ইতিহাস সবার জানা।

বাংলা গানের অনেকগুলো ধারা বহমান। তার মধ্যে লোকসংগীত বা লোকগান বাঙালির শেকড়। গ্রামের কৃষক থেকে শহরের। উচ্চশিক্ষিত নাগরিক লোকগানকে ভালোবাসেন। তার বড় প্রমাণ নিকট অতীতে ভার্চুয়াল জগতে ভাইবাল হওয়া “সর্বত মঙ্গল রাধে, বিনোদিনী রাই” বা “যুবতী রাধে” গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। গানের প্রথম লাইটিতে রূপক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণ চোখে গানটি সাধারণ মনে হলেও এর অর্থ ও ভাব অনেক গভীর। গানের অর্থোদ্ধার ও ভাবরস আস্বাদনে আমাদের গানে ব্যবহৃত কিছু রূপক শব্দের সাথে পরিচিত হই। তাহলে আমাদের ভিন্ন অর্ন্তদৃষ্টি তৈরি হবে। গানের পূর্ণ উপভোগের জন্য এটি প্রথম শর্ত। সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সুফিতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব, মরমিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব বিষয়ক লোকগানে রূপক শব্দের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। রূপক শব্দ বা গানের দুটি অর্থ। একটির অর্থ শব্দগত বা ভাষাগত, যা বাহিরের। অন্যটির অর্থ রূপের আড়ালে থাকা আরেক রূপ। রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি। এই গানটিও রূপক গান। গানটি নর-নারীর প্রেমের গান মনে হয়। কিন্তু এর আরেকটি আধ্যাত্মিক বা মরমি রূপ হলো কবিগুরুর অন্তরে পরম সত্ত্বা বিরাজমান। তাঁর অর্ন্তদৃষ্টির অক্ষমতায় সেই পরম সত্ত্বাকে তিনি দেখতে পারছেন না। এজন্যই তাঁর বিরহী মনের যত আক্ষেপ। বাংলার সাধক ও লোককবিগণ তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দিয়ে তৈরি করেছেন মাধুর্যে ভরা এসব রূপক গান। শত সহস্র রূপক গানের মধ্যে সুপরিচিত কয়েকটি নিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়।।

“আমার পোষাপাখি উড়ে যাবে, সজনী/একদিন ভাবি নাই মনে” কিংবা “আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা ওইড়া রে” বাংলার এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে এ দুটি গানের সাথে পরিচিত নয়। গ্রামের মেঠো পথ কিংবা শহরের পিচঢালা পথ, দরিদ্রের কুটির কিংবা ধনীর গৃহ-সবখানেই ভেসে আসে এসব গানের সুর। আমরা যার যার অবস্থান থেকে এসব গানের অর্থ খুঁজে নিই। ‘পোষাপাখি’ বা ‘সোনার ময়না পাখি’ যে আমার দেহের চৈতন্য বা আত্মা এবং অনিত্য দেহে সে চিরস্থায়ী নয়, সে কথাই এ রূপক গানে উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যিই তো! ‘পোষাপাখি’ চিরস্থায়ী নয়। কত বেদনাদায়ক উপলব্ধি আমাদের লোকগানের কবিদের। সাধক লালন ফকিরের “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি/কেমনে আসে যায়” একটি রূপক গানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আসা-যাওয়ার এ ‘অচিন পাখি’-কে তিনি বেঁধে রাখতে অস্থির। তাঁকে তিনি বেড়ি পরাতে চান। পরমাত্মার রূপক নাম ‘অচিন পাখি’। লালন এঁকে ‘মনের। মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘মানুষ রতন’, ‘সোনার মানুষ’ ইত্যাদি রূপক নামে তাঁর বিভিন্ন গানে উল্লেখ করেছেন। এ মানুষকে পাওয়ার জন্য তিনি মানুষকে ভজন সাধন করতে অথবা মানববাদী হতে বলেছেন। কি সহজ, সাবলীল ভাষায় তিনি গান লিখেছেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।” সত্যিই তা-ই। জগতের সবকিছুই মানুষকে ঘিরে। গানের তাথায় বলব, “কাশী কিংবা মক্কায় যাও রে মন/দেখতে পাবে মানুষের বদন/ধ্যানধারণা ভজনপূজন মানুষ সর্ব ঠাঁই।” মানুষকে ভালোসেসেই সত্যিকার মানুষকে পাওয়া যায়। লালনের একটি সুপরিচিত গান “বেদে নাই যার রূপরেখা/প্যবে সামান্যে কি তাঁর লেখা? এ গানের প্রথম অন্তরাটুকু দেখে নিই:

“সবে বলে পরম ইষ্টি কারো না হইলো দৃষ্টি। বরাতে করিল সৃষ্টি তাই লয়ে লেখাজোখা।।”

দেহের যে মালিক পরমাত্মা, তার সাথেই তো মানুষের সর্বদা বসবাস। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ তাঁকে চিনতে বা দেখতে পারি না তাঁকে চিনতে হলে “সহজ মানুষ’ বা সাধক হতে হবে। পরমাত্মাকে লালন ‘পরম ইরি’ বলেছেন। তার পরের লাইনে লালন মানবসৃষ্টি প্রথম উপাখ্যানটি তুলে ধরেছেন। “বরাতে করিল সৃষ্টি’ মানে প্রষ্টার নির্দেশে বা আদেশে মানুষ সৃষ্টি করাকে বুঝানো হয়েছে। এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের পরমেশ্বর (আল্লাহ) তাঁর সৃষ্টি জগতের পূর্ণতার জন্য ফেরেশতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মানব সৃষ্টি করতে। এ ঘটনা আমাদে সবার জানা। এটিকে লালন তাঁর কাব্যপ্রতিভা-গুণে রূপক শব্দযোগে প্রকাশ করেছেন। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই, সৃষ্টিলোয় মানুষকে ঘিরেই চলছে সবকিছু। অরণ্য থেকে নভোচরের সর্বত্রই মানুষের কর্মযজ্ঞ। তাই লালন বলেছেন, “তাই লয়ে লেখাজোখা” মানে মানুষকে নিয়েই সব কর্মযজ্ঞ।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু আনমনে” একটি সার্থক রূপক গান। স্রষ্টাকে রিট ‘শিশু’ বলে ধ্যান-জ্ঞান করেছেন। শিশু যেমন তার খেয়াল-খুশিতে চলে, স্রষ্টাও তেমনই। ধ্বংস-সৃষ্টি, পাপ-পুণ্য, জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টিকর্ত লীলা। এ পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মান্ত শিশুরূণী স্রষ্টার লীলাক্ষেত্র। মানুষ তার পুতলনাট্যের বিবিধ চরিত্র। এ রূপক গানের বিশ্লেষণ পাওয়া যা আব্দুল আলীমের দরদি কণ্ঠে গাওয়া “এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া/এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই” গানে। অবধারিতভাবে প্রশ্ন এল যায় ধ্বংস-সৃষ্টি যদি স্রষ্টার লীলা হয়, তবে কেন তিনি এতো সুখের অপরূপ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন? রহস্যময় এ প্রশ্নের সার্বজনী উত্তর পাওয়া কঠিন। এজন্যই বুঝি জীবন ও জগত এত বৈচিত্র্যময়।

রাধা-কৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কয়েকটি রূপক গানের উল্লেখ করা যায়। আমরা জানি, হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শাখা বৈষ্ণব ধর্ম। বৈষ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণব সাহিত্য। এ ধর্মসাহিত্যে কৃষ্ণ পরমাত্মা বা ঈশ্বরের প্রতীক, বাধা জীবাত্মা বা প্রাণিকুলে প্রতীক। কৃষ্ণ হলো বিষ্ণুর অবতার বা পরমেশ্বর। আর রাধা হলো প্রকৃতিক অবতার। তাই রাধা-কৃষ্ণ লীলা কিন্তু মানবপ্রেম নয়। বরা লীলা হলো ঈশ্বরপ্রেমের প্রতীক। কবির ভাষায়, “রাধা-কৃষ্ণ এক আগ্রা দুই দেহ ধরি।” অন্যদিকে সুপরিচিত গান, “সর্বত্র মঙ্গল রাজ বিনোদিনী রাই” গানের শুরুর অংশটি রূপকাশ্রিত। কৃষ্ণের যে রাধা বা প্রকৃতি বা জীবাত্মা, তা সর্বত্র ও সর্বদা কল্যাণময়, আনন্দম প্রেমময়। গানের পরবর্তী অন্তরাগুলো কাহিনীমূলক, যা সহজে বোধগম্য। লোককবি দীনহীনের “আইজ পাশা খেলব তে শ্যা রূপকাশ্রিত শ্রোতাপ্রিয় আরেকটি গান। গানটি নব্বইয়ের দশকে গ্রামবাংলা, শহর ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুনভাবে সাড়া জাগিয়েছিল গানটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, পাশা খেলার ছলে ভগবান শ্যামকে (কৃষ্ণের ১০৮টি নামের মধ্যে শ্যাম একটি) আজন করছে রাধিকা। কিন্তু রাধার (জীবাত্মার) শঙ্কা আছে তাঁকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখা যাবে কি না। তাই রাধিকা বৃন্দাবনের সব সখিকে কৃষ্ণকে ঘিরে রাখতে চায়। গানের পরবর্তী অংশে কৃষ্ণপ্রেমে রাধিকার অর্ঘ্য হিসেবে সুগন্ধি, আতর, গোলাপ, চন্দন দেওয়ার কালি বর্ণনা আছে। সবশেষে গানের ভণিতায় ও আভোগে বাউল দীনহীন স্রষ্টপ্রেমে নিজেকে উজাড় করেছেন আত্ম্য নিবেদনের মাধ “দীনহীন আর যাবে কোথায় বন্ধুর চরণ বিহনে? রাঙা চরণ মাথায় লইয়া কান্দে দীনহীনে।”

লেখার গোড়াতে বলেছিলাম, বাংলা ভাষা শুরু হয়েছে বাংলা গান দিয়ে। তাই আমাদের আদি সাহিত্য বাংলা গীতিকাব্য বা ধর্মীয় সাধনাগীতি। অন্যদিকে বাংলার আদি পেশা কৃষি। কৃষি দিয়েছে আমাদের অন্ন, যা জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য আর গান দিলে আনন্দ, যা অন্তরকে সমৃদ্ধ করার জন্য অনিবার্য। বস্তুত মানবজীবনের লড়াই অন্ন ও আনন্দকে ঘিরেই। স্রষ্টা একই সাথে অন্নময় আনন্দময় সত্ত্বা। বোধ ও অন্তদৃষ্টির চোখ মেলে এই আশ্চর্য মিলকে প্রত্যক্ষ করা যায়। আমাদের কর্মজীবনের কথা যেখানে ফুি যায়, গানের সূচনা ঘটে সেখান থেকেই। মনের ভাব, রস, মাধুর্য, সুর ও ছন্দের সমাহার নিয়ে রূপক গান। তাই কথার চেয়ে গানই তাৎপর্যময়। গান জগতের কথা কয়, জীবনের কথা কয়, ঈশ্বরের কথা কয়। সকল ধর্ম, সকল দর্শন, সকল মতের সমন্বয়ন ভাবনা রয়েছে এসব গানে। তাই তো বাঙালি হয়েছে মানবপ্রেমী, অন্যের দুঃখে কাতর, ভালোবাসায় ব্যাকুল কোমল হৃদয়ের মানুষ।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি

ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট
error: Content is protected !!