নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের প্রধান দুঃখ নদীভাঙন। মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে প্রতি বছর ভেঙে যাচ্ছে বসতঘর, ফসলি জমি, স্কুল, মসজিদ, কবরস্থান, দালানকোঠা ও হাটবাজার। বছরের পর বছর চলতে থাকা এ ভাঙন হাতিয়ার অসংখ্য মানুষকে করেছে গৃহহীন ও নিঃস্ব। নদীর করালগ্রাসে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপাড়ের হাজারো পরিবার। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশার বাণী শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধান মেলেনি।
বিশেষ করে হরনী, চানন্দী, সুখচর, নলচিরা, চরইশ্বর ও সোনাদিয়া ইউনিয়নের মানুষ এ ভাঙনের সবচেয়ে বড় শিকার। স্বাধীনতার পর থেকে শতশত প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং ঐতিহ্যবাহী হাটবাজার নদীতে বিলীন হয়েছে। দীর্ঘদিন ভাঙতে থাকায় বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বারবার স্থান পরিবর্তন করেও রক্ষা হয়নি। নতুন করে ঘর গড়ার স্বপ্ন দেখার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে।
চরইশ্বর ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিজের ভিটেমাটি হারিয়ে নদীর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পাশে খালি ভিটায় পায়চারি করছেন কয়েকজন নারী। তাদের একজন, সোভা রানী, সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে জানালেন, ‘বাড়ি তিনবার ভেঙেছে। যা কিছু ছিল, সব শেষ। সাত বছর আগে সাপের কামড়ে স্বামী মারা গেছে। বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। শেষ মেষ মেয়ে বেগগুনে (ভারতে) চলে গেছে। আমি মেয়ে নিয়ে নদীর কূলে থাকি। দুজন মিলে নৌকায় মাছ ধরি, যা পাই, তা দিয়েই কোনোমতে খাই-না-খাই দিন কাটাই। মাথা গোঁজার কোনো জায়গা নেই। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে—এটাও এক বোঝা। কী করব, বুঝতে পারি না।’
বৃদ্ধ রবিউল হোসেন (৬৫) বলেন, ‘একসময় জায়গা-জমি সবই ছিল, বাড়ির সামনে স্কুল-মসজিদ ছিল। সাতবার ভাঙনের শিকার হয়ে সব হারিয়েছি। এখন নদীর ঢালে কোনোমতে চারপা ফেলে থাকি। জোয়ার এলে ঘরে থাকতে পারি না। এই বর্ষায় ভিটেটাও টিকবে না। বহুদিন ধরে শুনছি এখানে ব্লক বাঁধ হবে; কিন্তু কোনো কাজের খবর পাই না।’
জাকিয়া খাতুন (৬০) জানালেন, ‘২০ বছর আগে স্বামী মারা গেছে। নদী চারবার ঘর নিয়ে গেছে। এখন খালি ভিটে পড়ে আছে। সামর্থ্য নেই নতুন করে ঘর তুলব। রাত হলে অন্যের ঘরে থাকি, দিন হলে মানুষের বাসায় কাজ করলে খাই, না হলে উপোস। আমাদের দেখার কেউ নেই।’
শুধু সোভা রানী, রবিউল বা জাকিয়া নয়—তাদের মতো শতশত পরিবার প্রতি বছর নদীতে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন। সরকারি সহায়তা না পেয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন বাঁধের ধারে, খাসজমিতে বা আত্মীয়দের বাড়িতে।
নদীভাঙনে শুধু ঘরবাড়ি নয়—নষ্ট হচ্ছে একমাত্র জীবিকার উৎস ফসলি জমিও। ফলে কৃষকরা কর্মহীন, জেলেরা নদীর ভয়াবহতায় মাছ ধরা থেকেও বিরত। অভাব-অনটনে প্রতিদিনের খাবার জোটানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত, শিক্ষকরা বদলি হয়ে যাচ্ছেন, আর অভিভাবকরা দিশাহারা হয়ে পড়ছেন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মেঘনার ভাঙন বাড়ে, তবে এবার এর তীব্রতা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বাজারসহ আশপাশের এলাকাও হুমকির মুখে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার আবেদন জানালেও স্থায়ী কোনো প্রকল্প হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (হাতিয়া) জামিল আহমেদ পাটোয়ারী জানান, ‘নদীভাঙন রোধে হাতিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে জিও টেক্সটাইল দিয়ে প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ নির্মাণ চলছে। ঘাট এলাকায় জিও ব্যাগ এবং জিও টিউব দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ শুরু হয়েছে। এবারের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে অস্থায়ীভাবে এসব কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।’
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘হাতিয়ার নদীভাঙন পুরোনো সমস্যা। মূল কারণ নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও প্রবল জোয়ার-ভাটা। স্থায়ী নদীশাসন ও তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি এবং মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তবে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’
হাতিয়ার নদীভাঙন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়—এটি এখন মানবিক বিপর্যয়। প্রতিনিয়ত মানুষ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, যেন তারা রাষ্ট্রের আলো থেকে বিচ্ছিন্ন এক নিখোঁজ জনগোষ্ঠী। তাই এলাকাবাসী এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।