আমরা প্রতিদিন বহু মানুষের সঙ্গে দেখা করি, কথা বলি, হাসি, রাগ করি—সবকিছুতেই থাকে নানা রকম মুখাবয়ব। তবে সব মুখ কি সত্যিকারের? নাকি মুখোশের আড়ালে লুকানো? এই প্রশ্নটি আজকাল খুবই প্রাসঙ্গিক, কারণ বাস্তব জীবনে মানুষ তার আসল রূপ না দেখিয়ে মুখোশ পরে বাঁচে। এই মুখোশ কখনো সৌজন্য, কখনো কৌশল, আবার কখনো প্রতারণা।
একজন মানুষ তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। পরিবারে সে একরকম, কর্মস্থলে আরেকরকম, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভিন্ন রূপে। এসব ভিন্নতা অনেক সময় প্রয়োজনীয় হলেও কখনো কখনো তা কৃত্রিমতার জন্ম দেয়। মানুষ নিজের দুর্বলতা, কষ্ট, অসততা বা লোভ ঢাকতে মুখোশ পরে। এতে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, আস্থার জায়গায় জায়গা করে নেয় সন্দেহ।
রাজনীতি, সমাজ কিংবা কর্মক্ষেত্রে মুখোশ পরার প্রবণতা আরও বেশি। নেতারা অনেক সময় জনগণের সামনে একরকম আচরণ করেন, বাস্তবে করেন ঠিক উল্টো। সমাজে কেউ কেউ ভদ্রতার মুখোশ পরে অসৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে রাখেন। আবার কিছু সম্পর্কেও মুখোশ থাকে—ভালোবাসার অভিনয় করে কেউ কারো আবেগ নিয়ে খেলে, বন্ধুত্বের নাম করে প্রতারণা করে।
তবে সব মুখোশই যে নেতিবাচক, তা নয়। কেউ কেউ নিজের কষ্ট বা দুর্দশা আড়াল করতে মুখে হাসি রাখেন—এটিও এক ধরনের মুখোশ, যা মানবিক। এই মুখোশ কারো ক্ষতি করে না বরং সমাজে সৌহার্দ্য বজায় রাখতে সহায়ক। কিন্তু যখন মুখোশের আড়ালে থাকে প্রতারণা, হিংসা বা ভন্ডামি—তখনই তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে বড় বিপদ তখন হয়, যখন মানুষ নিজের মুখোশেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সে নিজের আসল পরিচয় ভুলে যায়। সে বুঝতেই পারে না তার কোন মুখটি আসল, কোনটি মুখোশ। আত্মপরিচয় হারিয়ে যায় মুখোশের ভারে। তখন সম্পর্ক হয় ভঙ্গুর, সমাজ হয় ভাঁওতাবাজিতে ভরা।
তবে যারা মুখোশহীনভাবে বাঁচে, তারা সংখ্যায় কম হলেও সমাজের জন্য আশীর্বাদ। তারা সত্যবাদী, সরল, স্বচ্ছ। তাদের চিনতে সময় লাগে না, কারণ তারা কিছুই লুকিয়ে রাখে না।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ মুখোশ চিনে নেওয়া এবং তা ধীরে ধীরে সরিয়ে রাখা। নিজেকে যেমন তেমনই গ্রহণ করা, অন্যকেও তেমন ভাবেই গ্রহণ করতে শেখা। মুখোশের পেছনে যে মুখ লুকিয়ে থাকে, তা যদি সত্য হয়, তবে তা-ই আমাদের শ্রেষ্ঠ পরিচয়।