ইংরেজরা প্রথম আবির্ভাব করে ১৬০১ সালে; ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে ভারতে ব্যবসার ছদ্মবেশে প্রবেশ করে। প্রথমে বাধশা জাহাঙ্গীর তাদের বিশ্বাস করে নানা সুবিধা ও জমি পানামধ্য দিয়ে ইংরেজদের ক্ষমতা বেড়ে ওঠে। শতবর্ষের মধ্যেই তারা দেশে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নানা অঞ্চল শাসন করতে থাকে — ১৭১৭, ১৭৪০ সালের মধ্যে তারা আরও বিস্তার লাভ করে। শেষপর্যায়ে ‘দেশ বাদশার, আইন আমাদের, শাসনযোগ্যতা কোম্পানির’—এমন বাস্তবতাই বিরাজ করে।
দিল্লির হাদিসবিদ শায়খ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) তার ছাত্র-শিষ্য সমাজকে সতর্ক করেন—ইংরেজ শাসন দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে এবং এটি মুসলিম সমাজের জন্য বিপজ্জনক হবে। তার কৃতিত্ব ও সতর্কবার্তা পরবর্তীতে বহু আলেমের মধ্যে আন্দোলনের বীজ বোনা শুরু করে।
তার ছেলের কন্যা-সন্তান ও শিষ্যরা—বিশেষত শাহ আবদুল আজিজ—ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো ফতোয়া দেন। শাহ আবদুল আজিজ ১৭৭২ সালে ঘোষণা করেন যে ভারতবর্ষ এখন ‘দারুল হরব’—অর্থাৎ মুক্ত করতে জিহাদ ফরজ, এবং পরে তার ও তার অনুরাগীদের সক্রিয় প্রতিরোধ শুরু হয়।
টিপু সুলতানও (মহিষুর রাজ্যের বিপুল প্রতিরোধক) ইংরেজদের বিরুদ্ধে রণসংগ্রামে নামেন; তিনি ১৭৯৯ সালে শহিদ হন। এ সময়ে মুসলিম সমাজে খানিক বিভক্তি তৈরিও হয় — কিছু নেতা ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় লোভে পড়ে মিত্রতা করে ফেলেন, অন্যরা抵抗 অব্যাহত রাখেন।
পলাশীর যুদ্ধ হলো ইংরেজ শাসনের স্থায়ীত্বের এক মাইলফলক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে মীর জাফরকে অর্থের বিনিময়ে কৃত্রিমভাবে নিয়োজিত করা হয়; এর ফলে স্বাধীন শক্তির পতন ঘটে এবং স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতের পথ শুরু হয়।
১৮শ শতকের পরে পাঞ্জাব জয় করে রাজা রঞ্জিত সিং মুসলমানদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালান — মসজিদ ধ্বংস, পরিবারে জুলুম ইত্যাদি। এ ঘটনার বিরুদ্ধে উঠে আসেন সাইয়্যিদ আহমদ ব়েরেলভি; তিনি বহু মুজাহিদ নিয়ে পাঞ্জাবে লড়াই শুরু করেন এবং ১৮৩১ সালের বালাকোট যুদ্ধে শহিদ হন।
এ সময়কাল নানান আলেমদের ওপর ইংরেজদের দমন-পীড়ন ও হত্যা-নির্যাতনের কালপর্বে পরিণত হয়। ১৮৬৪–৬৭ সালের মধ্যে প্রচলিত তথ্যানুসারে হাজারো আলেমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়—এই ভূমিকা মুসলিম সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক বদল আনে—ফার্সি ও ধর্মীয় শিক্ষার স্থান দখল করে ইংরেজি নাগরিক শিক্ষার জোরালো প্রবর্তন। লর্ড ম্যাকোলের মত নীতিমালা ভারতীয় শিক্ষা-চেতনায় বিলেতি মূল্যবোধ প্রবেশ করায় এবং মুসলিম সমাজকে আর্থিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এগুলোই একদিকে ছিল রাজনৈতিক শোষণ, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অবক্ষয়ের কারণ।
১৮৫৭ সালের উত্তেজনাপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামে ও পরবর্তী রেশমি রুমাল আন্দোলনে বহু আলেম ও ধর্মীয় নেতার সক্রিয়তা ছিল—মুহাজিরে মক্কি, মাওলানা কাসেম নানুতবি, মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি প্রমুখের নেতৃত্বে বহু আন্দোলন ও লড়াই সংঘটিত হয়। যদিও সেগুলো সফলভাবে স্বাধীনতা আনতে ব্যর্থ হয়, তবু আলেম সমাজের প্রতিরোধ ও ঐক্যের ইতিহাস গঠন করে।
এ দীর্ঘ, হৃদয়বিদারক ও প্রতিকূল ইতিহাস—রাজনৈতিক শোষণ, সামাজিক-আর্থিক অবক্ষয়, আলেমদের ওপর দমন ও শিক্ষার পরিবর্তন—ই ছিল দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেক্ষাপট। ১৮৫৭-এর পরের পরিস্থিতি, আলেম সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজন এবং ইসলামী শিক্ষা ও মর্যাদা রক্ষা করার তাগিদই শেষপর্যায়ে দেওবন্দের মত প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটায়। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা ছিল কেবল একটি শিক্ষাসংস্থার জন্ম নয়—এটি ছিল আত্মরক্ষা, পুনর্গঠন ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপনের প্রয়াস।