
চুঁইঝালের মাংসের নাম উঠলেই মনে পড়ে খুলনা ও চুকনগরের কথা। গরু বা খাসির মাংসে চুঁইঝালের ঝাঁজ রসনার পরিতৃপ্তি বাড়ায় বহুগুণ। এখন এই চুঁইঝালের মাংস শুধু চুকনগরেই সীমাবদ্ধ নয়—ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নামি-দামি রেস্তোরাঁর পাশাপাশি খুলনাতেও দিন দিন বাড়ছে এই স্বাদের পরিসর। এক সময়ের শিল্পনগরী খুলনা এখন রূপ নিচ্ছে হোটেল-রেস্তোরার মহানগরীতে।
সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও জানা গেছে, গত এক দশকে খুলনা মহানগরী ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ২০০টির মতো হোটেল ও রেস্তোরা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত ২-৩ বছরে এই সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ হিসেবে মানুষ এখন হোটেল ব্যবসায় ঝুঁকছে। এর বড় একটি অংশ ফাস্টফুড ও রেস্তোরা খাতে।
খুলনা সিটি করপোরেশন ও হোটেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সিটিতে ট্রেড লাইসেন্সের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে কয়েকশই হোটেল ও রেস্তোরা। আপ্যায়ন, শামীম হোটেল, ডিলাক্স, কস্তুরি, মেগা, কাচ্চিঘর, নুর কাচ্চিঘরের পাশাপাশি নতুন করে শাখা গেড়েছে কাচ্চিভাই, সুলতান ডাইনিং, নানা কাচ্চিঘর, সেই স্বাদসহ বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান।
চুঁইঝালের মাংসকে ঘিরে নগরীর জিরো পয়েন্টে প্রায় ২০টি, আর চুকনগর ও ডুমুরিয়া বাজার এলাকায় আরও ১৫–২০টি রেস্তোরা গড়ে উঠেছে। সাতরাস্তা মোড়, শিববাড়ি মোড়, নিউমার্কেট, সোনাডাঙা বাস টার্মিনাল, রূপসা ঘাট, দৌলতপুর মোড়, পিকচার প্যালেস মোড়, স্টেশন রোডসহ শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় হোটেলের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে খুলনা মহানগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০০টির বেশি হোটেল-রেস্তোরা রয়েছে।
শামীম হোটেলের মালিক শামীম হোসেন বলেন, হোটেল ব্যবসা এখন অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন হোটেল গড়ে উঠছে, মানুষ নতুন জায়গায় যেতে আগ্রহী। ফলে টিকে থাকতে এখন প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে খুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ২০টির মতো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে—নিউজপ্রিন্ট, হার্ডবোর্ড, টেক্সটাইল, দাদা ম্যাচ, অক্সিজেন প্লান্টসহ অনেক কারখানা। এছাড়া বেসরকারি পাট, পাটজাত পণ্য ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত শিল্পও অনেকটাই নিভে গেছে। ফলে কম পুঁজি ও সহজ পরিচালনাযোগ্য ব্যবসা হিসেবে হোটেল-রেস্তোরা এখন অনেকের আশ্রয়স্থল।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হোটেল ব্যবসায় তুলনামূলকভাবে কম পুঁজি লাগে এবং লাভের সম্ভাবনাও ভালো। এতে পরিবারের সদস্যরাও যুক্ত হতে পারেন। তাই বিকল্প কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে এটি এখন খুলনার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, তরুণরা এখন বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে হোটেল ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন।
খুলনা সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স অফিসার খান হাবিবুর রহমান জানান, খুলনা সিটিতে ২০ হাজারের বেশি ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে, যার মধ্যে হোটেল ও রেস্তোরা খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা সেক্টরভিত্তিকভাবে এসব ব্যবসাকে শ্রেণিবদ্ধ করার কাজ শুরু করেছি, যদিও নির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো বলা সম্ভব নয়।
একসময় যেখান থেকে শিল্পকারখানার ধোঁয়া উঠত, আজ সেই খুলনাই চুঁইঝালের মাংসের সুবাসে ভরে উঠছে—রসনা তৃপ্তির শহর হয়ে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি
Leave a Reply