বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সফল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে এ খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর স্বপ্ন বাঙালি জাতি লালন করেছিল, তা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও পূর্ণতা পায়নি। বারবার গণতন্ত্রের পথে বাধা এসেছে, রাজনৈতিক দলীয়করণে দুর্বল হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর একটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় এসে ক্রমাগত স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করে। বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের অভিযোগ উঠতে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’-এ বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা অংশ নেয়। এই গণ-অভ্যুত্থানে নারী ও শিশুসহ ১৪০০ নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি আহত হয়। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে স্বৈরাচারী সরকার পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয় এবং জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়।
৮ আগস্ট ২০২৪-এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয় এবং ৭ অক্টোবর ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে:
সংবিধান সংস্কার কমিশন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন
পুলিশ সংস্কার কমিশন
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন
এই কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে তাদের সুপারিশসমূহ সরকারের কাছে জমা দেয়।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। কমিশনের কাজ ছিল ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে ঐকমত্য গঠন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ প্রদান।
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রেরণ করে। এরপর ৫ মার্চ ২০২৫ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সংগ্রহ ও আলোচনা শুরু হয়।
প্রথম পর্যায়ে ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে অগ্রাধিকারভিত্তিক ২০টি বিষয়ে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়।
এই দীর্ঘ পর্যালোচনা ও আলোচনার ফলস্বরূপ রচিত হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। এতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ দেশের শাসন ব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তরের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়।
সনদে নিম্নোক্ত অঙ্গীকারগুলো করা হয়েছে:
১. আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের ত্যাগের মর্যাদা রক্ষায় সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
২. শাসন ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান ও আইন সংশোধন।
৩. সনদ গৃহীত হওয়ার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পন্ন।
৪. প্রতিটি সংস্কার ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
৫. আন্দোলনের ইতিহাসকে সংবিধানে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া।
সনদের প্রথম পর্বে ঐকমত্যের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষে চূড়ান্ত সংস্কার বিষয়গুলো যুক্ত হবে। এই সনদের বাস্তবায়ন পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের প্রথম দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার অঙ্গীকারও দলগুলো করেছে।
এই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী দলিল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথনির্দেশনা হিসেবে এর বাস্তবায়ন হবে জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
চেয়ারম্যানঃ এম এস চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালকঃ মোঃ এম রহমান, ঠিকানাঃ টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত