মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত চলনবিলে ভরা মৌসুমেও দেশি প্রজাতির মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। আগে বর্ষা শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাসে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু নানা অনিয়ম, দূষণ ও কালের বিবর্তনে এখন মাছের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জেলেরা বিপাকে পড়েছেন এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা দেশি মাছের স্বাদ হারাচ্ছেন। পাঙ্গাশ ও কার্পজাতীয় মাছই এখন তাদের ভরসা।
প্রায় ৮০০ বর্গমাইল আয়তনের চলনবিল নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের ১০টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বিলজুড়ে আত্রাই, গুমানী, তুলশীগঙ্গা, বড়ালসহ ৪৭টি নদ-নদী প্রবাহিত। গুরুদাসপুরে বড়বিল, চাকলবিল, খলিষাডাঙ্গা বিলসহ অসংখ্য বিল রয়েছে যেখানে একসময় দেশি মাছের ছড়াছড়ি ছিল। আগে এই বিলজুড়ে টেংরা, পুঁটি, কই, মাগুর, টাকি, শোল, বোয়াল, চিংড়ি, চাপিলা, পাবদা, রুই, কাতলা, কালিবাউশ, খলিশা, রায়েক, বাইন, কাকিলা, রিটা, বাঘাইড়, বাঁশপাতা, ফেসাসসহ নানা দেশি মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে নদী-খালের নাব্যতা হ্রাস, অবৈধ জাল ব্যবহার, কীটনাশকের প্রভাব, মা মাছ নিধনসহ নানা কারণে চলনবিল হারাচ্ছে ঐতিহ্য।
‘মৎস্য ভান্ডার চলনবিল’ এখন ইতিহাস। চলনবিল এলাকা থেকে আহরিত মাছের অধিকাংশই বৃহৎ আড়ত মহিষলুটিতে বিক্রি হয়। মাছের জোগান সীমিত হওয়ায় আড়তেও দাম বেশি। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে চলনবিলে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন ছিল ৩৬,৯৯০ মেট্রিকটন, ২০০২ সালে ১২,৬৬০ মেট্রিকটন, ২০০৯ সালে ১০,০০০ মেট্রিকটন এবং ২০১২ সালে ৮,৭০০ মেট্রিকটনে কমে যায়।
গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় বাজারের মাছ ব্যবসায়ী জীবন শিকদার ও সুকু হালদার জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি বাইন ১ হাজার, গুঁচি ৭০০, টেংরা ৬০০, বোয়াল ৭০০, পুঁটি ৩০০, রায়েক ৬০০, চিংড়ি ১ হাজার, পাবদা ১ হাজার, চাপিলা ৪০০, চেলা ৬০০, টাকি ৪০০, বাঁশপাতা ৮০০, কই ৬০০, মাগুর ৬০০, শোল ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আড়ৎ ব্যবসায়ী আবদুস সোবহান ও আসাদ আলী বলেন, দেশি মাছের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম চড়া। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পক্ষে মাছ কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তবে পুকুরে চাষ করা মাছ কিছুটা আমিষের চাহিদা মিটিয়ে দিচ্ছে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান বলেন, অনেক প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চলনবিলের বিভিন্ন খাল-বিল খনন ও নতুন অভয়াশ্রয় তৈরি, পাশাপাশি পুুরাতনগুলোতে মা মাছ সুরক্ষা নিশ্চিত করলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মাছ আবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো সম্ভব।
চাঁচকৈড় বাজারে মাছ কিনতে আসা জবতুল্লাহ মন্ডল ও আখতার হোসেনরা জানান, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে কমদামে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না। কারেন্টজাল ও চায়না দুয়ারী জালের কারণে মা মাছসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ লোক দেখানো অভিযান ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গুরুদাসপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রতন কুমার সাহা বলেন, এবার বর্ষা এসেছে দেরিতে। মা মাছ সময়মত ডিম ছাড়তে পারেনি। অভিযান সত্ত্বেও জনসচেতনতার অভাবে চায়না দুয়ারী জাল ব্যবহার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।