
মাগুরা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে মহম্মদপুর উপজেলায় অবস্থিত সীতারাম রাজার বাড়ি বর্তমানে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। স্থানীয়রা বাড়িটির সংস্কার ও সংরক্ষণ করে ঐতিহ্য রক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। মহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পাশে এই প্রাসাদের অবস্থান। রিকশা, ভ্যান অথবা হেঁটেই সেখানে যাতায়াত করা যায়।
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা মানসিংহ যখন রাজধানী স্থাপন করেন, তখন শ্রীরাম দাস ‘খাস বিশ্বাস’ উপাধি লাভ করেন। তার ছেলে হরিশচন্দ্র অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেন এবং পরে ঢাকায় গিয়ে ‘রায় বাঁয়া’ উপাধি পান। হরিশচন্দ্রের ছেলে উদয় নারায়ণ ফৌজদারের অধীনে সাজোয়াল বা তহশিলদার নিযুক্ত হয়ে মহম্মদপুরে আসেন। তারই ছেলে ছিলেন সীতারাম।
মাগুরা জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে মধুমতি নদীর তীরে মহম্মদপুর উপজেলা, যেখানে সীতারামের রাজধানী ও বাসস্থান ছিল। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ উপন্যাসে তার নাম সুপরিচিত। সীতারামের বাবা উদয় নারায়ণ নবাব সরকারের রাজমহলে কাজ করতেন এবং পরে ভূষণা পরগণায় তহশিলদার নিযুক্ত হন। তার স্ত্রীর নাম ছিল দয়াময়ী।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক ডা. কাজী তাসুকুজ্জামান জানান, মহম্মদপুরের শ্যামনগর গ্রামে সীতারামের কিছু ভূ-সম্পত্তি ছিল। এক প্রবাদমতে, একবার সেখান দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় তার ঘোড়ার পা মাটির নিচে আটকে যায়। পরে খনন করলে মন্দিরের চূড়া ও লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রোহ পাওয়া যায়। সীতারাম তখন এখানে নিজের বাসভবন নির্মাণ করেন এবং লোকজন বসবাস শুরু করে।
মহম্মদপুরে সীতারামের বহু কীর্তি এখনও বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রামসাগর, সুখসাগর, কৃষ্ণসাগর দিঘি, দোলমঞ্চ, রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ ও দশভূজা মন্দির উল্লেখযোগ্য। কথিত আছে, তিনি মুসলমান সৈন্যদলকে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন।
ইতিহাস গবেষক ও নাট্যকার সালাউদ্দিন আহমেদ মিল্টন বলেন, ‘সীতারাম রাজা দানশীল ছিলেন, আর তার মা দয়াময়ী তেজস্বিনী ছিলেন। অল্প বয়সে খড়গের সাহায্যে ডাকাত পরাস্ত করেছিলেন। মহম্মদপুরে আজও ‘দয়াময়ী তলা’ নামে একটি স্থান রয়েছে।’
কবি ও ইতিহাস গবেষক শিকদার ওয়ালিউজ্জামান জানান, রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ একটি দোতলা কাঠামোর ছিল এবং স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন সমন্বয় ছিল। বগিয়া ইউনিয়নের সীতারামপুর গ্রামে ‘সীতারামের পুকুর’ দেখা যায়। জমিদারি বিলুপ্তির পর প্রাসাদ ক্রমশ ধ্বংস ও অবহেলায় পড়ে।
বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রত্নস্থান হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তদারকিতে রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোগ কিছুটা জমি সংরক্ষণ ও পর্যটন ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। তবে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে পুরোপুরি সংস্কার সম্ভব হয়নি। অনুপ্রবেশ, অবৈধ দখল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্থাপনাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
স্থানীয়রা মনে করেন, প্রাসাদের জন্য পরিকল্পিত সংরক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া উচিত। এতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। জরুরি সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণন ও ছাদ মেরামত, প্রাচীর সংযোজন, বুরুশ ও সিল নষ্ট অংশ প্রতিস্থাপন। পুকুর পুনর্স্থাপন ও পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন গেট, প্রদর্শনী, মন্তব্য বোর্ড, গাইড ট্যুর ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা রাখা দরকার। এছাড়া জনগণকে সচেতন করার জন্য সংস্কৃতি ও ইতিহাসভিত্তিক কার্যক্রম, শিক্ষা কার্যক্রম ও মিডিয়া প্রচারণা চালানো জরুরি।
স্থাপনাটির নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সংস্থা, অনুদান ও সাংস্কৃতিক ফান্ড গ্রহণের মাধ্যমে ভবন ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। রাজা সীতারাম রায়ের বাড়ি শুধুমাত্র রাজকীয় প্রাসাদ নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে।
সরেজমিনে জানা যায়, জমিদার বাড়ির পেছনে রয়েছে বিশাল দিঘি ‘দুধসাগর’, যা সীতারামের ধনাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দুর্গ এলাকায় প্রবেশের আগে আরও দুটি পুকুর আছে—উত্তরের চুনাপুকুর এবং দক্ষিণের পদ্মপুকুর। দিঘিগুলো সাধারণ মানুষের পানীয় জলের ব্যবস্থা করত। সীতারামের বানানো ধুলজোড়া দেবালয় ১৬৮৮ সালে এবং কারুকর্যখচিত দশভূজার মন্দির ১৬৯৯ সালে নির্মিত হয়।
স্থানীয় তরুণ শামিম মৃধা বলেন, ‘সীতারাম রায়ের বাড়িটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহন করে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসে। গেট খোলা রাখার সময় বাড়ানো গেলে আরও ভালো হবে।’
প্রবীণ মো. মশিউর রহমান যোগ করেন, ‘বাংলার বিখ্যাত জমিদারের মধ্যে রাজা সীতারাম রায় অন্যতম। তার জমিদারি পাবনা, বরিশাল ও নদীয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।’
কেয়ারটেকার তরিকুল ইসলাম জানান, ‘মানুষ ঘুরতে আসে, ইতিহাস জানতে আসে। সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, তবে যতটুকু পারি জানানোর চেষ্টা করি।’
মহম্মদপুর ইউএনও শাহীনুর আক্তার বলেন, ‘রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক নিয়োগ আছে। বরাদ্দ পেলে সংস্কার কাজ শুরু করবো। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ আমাদের দায়িত্ব।’
মাগুরার জেলা প্রশাসক মো. অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তদারকিতে রয়েছে। সপ্তাহে সাত দিন খোলা রাখার বিষয়টি আমরা মনিটরিং করবো।’
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি
Leave a Reply