‘আমানত’ শব্দটি আরবি, যার অর্থ গচ্ছিত রাখা, নিরাপদে সংরক্ষণ করা ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা। ইসলামী পরিভাষায়, কারও কাছে কোনো অর্থ বা সম্পদ নিরাপদে রাখা বা গচ্ছিত রাখাকেই আমানত বলা হয়। যিনি সেই দ্রব্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন এবং প্রকৃত মালিক চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন, তাকেই ‘আমানতদার’ বলা হয়। অন্যদিকে, আমানতের খেয়ানত অর্থাৎ গচ্ছিত সম্পদ আত্মসাৎ করা গুরুতর অপরাধ এবং ইসলামে এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
মানুষের অর্থলিপ্সা ও লোভ তাকে ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত করে, ফলে সে বৈধ-অবৈধ সব পন্থায় সম্পদ অর্জনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাই ইসলাম আমানত রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন—
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানত তার মালিককে প্রত্যর্পণ করবে।”
(সুরা নিসা : ৫৮)
আরেক আয়াতে তিনি বলেন—
“তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দংশ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে পেশ করো না।”
(সুরা বাকারা : ১৮৮)
ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সুখী-সমৃদ্ধ জাতি গঠনে আমানত রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আমানতদারি ঈমানকে পূর্ণতা দেয়, তাকওয়া অর্জনে সহায়তা করে এবং মানুষকে পরকালে জান্নাতের অধিকারী করে। আল্লাহতায়ালা বলেন—
“যারা আমানত রক্ষা করে, তারা জান্নাতুল ফেরদাউসের অধিকারী হবে, যেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।”
(সুরা মুমিনুন : ১১)
হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই। আর যে ওয়াদা রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই।”
(মুসনাদে আহমদ : ১/৮০৫)
মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি দায়িত্বই এক একটি আমানত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।”
(তিরমিজি : ১২৪)
একজন মুমিনের জীবনে জান-মাল, মান-সম্মান, এমনকি কারও বলা গোপন কথাও আমানতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লামা কুরতুবি (রহ.) বলেন, আমানতদারি ইসলামি জীবনপদ্ধতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য—রাষ্ট্র পরিচালনা, অফিসিয়াল কাজ, শিক্ষকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রম ও দেশপ্রেম—সব ক্ষেত্রেই।
অমানতদারিতা বা খেয়ানত কবিরা গুনাহ এবং মুনাফেকির আলামত। নবী করিম (সা.) বলেন—
“মুনাফেকের আলামত তিনটি: ১. কথা বললে মিথ্যা বলে, ২. প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করে না, ৩. আমানত রাখলে তাতে খেয়ানত করে।”
(বোখারি : ২৬৮২)
একটি জাতির উন্নতি, স্থিতি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার নাগরিকদের আমানতদারিতার ওপর। তাই ইসলাম প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মধ্যে আমানতদারি ও বিশ্বস্ততার গুণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উৎসাহিত করেছে।
আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আমানতদার। অল্প বয়সেই তিনি ‘আল-আমিন’ বা ‘অতিবিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর সাহাবিরাও ছিলেন আমানতদারিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নবী করিম (সা.) বলেন—
“তোমার সঙ্গে চারটি জিনিস থাকলে পৃথিবীর সব হারালেও তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না—
১. আমানতের সংরক্ষণ,
২. সত্যবাদিতা,
৩. উত্তম চরিত্র,
৪. পবিত্র রিজিক।”
(আল মুসতাদরাক লিল হাকিম : ৭৯৮৯)
সর্বোপরি, আমানত রক্ষা শুধু একটি নৈতিক গুণ নয়, বরং ঈমানের অঙ্গ। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনোই আমানতের খেয়ানত করতে পারে না। আমানতদারি সমাজে শান্তি, ন্যায় ও বিশ্বস্ততার ভিত্তি স্থাপন করে, যা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য।