ভোর হতেই কোটচাঁদপুরের পুরোনো কলেজ হোস্টেলের সামনে শুরু হয় পাখিদের কিচিরমিচির। বিদ্যুতের তার, দোকানের ছাউনি কিংবা ভবনের টিনের চালজুড়ে বসে থাকা শত শত শালিক পাখি যেন কারও জন্য অপেক্ষা করে। সেই প্রতীক্ষিত মানুষটি মোহাম্মদ আলী শেখ—মমতা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক, যিনি টানা ৯ বছর ধরে প্রতিদিন পাখিদের খাওয়াচ্ছেন হোটেলের বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়ে।
খাবার পেয়ে প্রতিদিন সকালেই আসে পাখির দল। আর খাবার বিতরণ করে খুশি হন হোটেল ব্যবসায়ী আলী শেখও। এই নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসা ও যত্নে গড়ে উঠেছে মানুষের সঙ্গে পাখিদের এক অনন্য বন্ধন।
মোহাম্মদ আলী শেখ (৫৫) পেশায় একজন হোটেল ব্যবসায়ী। কোটচাঁদপুর পৌরসভার সলেমানপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ২১ বছর ধরে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং গত ৯ বছর ধরে নিয়মিতভাবে পাখিদের জন্য খাবার দিয়ে আসছেন। ফলে প্রতিদিনই বহু পাখি তাঁর হোটেলের আশপাশে জড়ো হয়।
সকাল ৬টা ৩০ মিনিট। কোটচাঁদপুরের মেইন বাজারে মমতা হোটেলের সামনে হঠাৎই দেখা গেল, বিদ্যুতের তার ও টিনের ছাদজুড়ে বসে আছে অসংখ্য শালিক। তারা তাকিয়ে আছে হোটেলের দিকে। তখনই হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন মোহাম্মদ আলী শেখ, হাতে ডেক ভর্তি খাবার। তিনি সেই খাবার ছড়িয়ে দেন দোকানগুলোর ছাদে। মুহূর্তেই পাখিরা নেমে এসে খাবার খেতে শুরু করে। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন তিনিও।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মোহাম্মদ আলী শেখ বলেন, “প্রথমে অল্প কয়েকটা পাখি আসত। এখন প্রতিদিন ৫০০–৬০০ পাখি আসে। হোটেলের বেঁচে যাওয়া খাবার জমিয়ে রেখে সকালে তাদের খাওয়াই। এতে দিনে এক থেকে দেড় শ টাকা খরচ হয়। তবে হোটেল বন্ধ থাকলে বা সব খাবার বিক্রি হয়ে গেলে পরোটা বানিয়ে দিই, কিংবা পাশের দোকান থেকে পাউরুটি কিনে খাওয়াই।”
তিনি বলেন, “ওদের কিচিরমিচির শুনতে ভালো লাগে। কখন যে এমন সখ্য গড়ে উঠেছে, টের পাইনি। এখন এটা জীবনের অংশ হয়ে গেছে।”
হোটেলে না থাকলে কে পাখিদের খাবার দেয়? জবাবে তিনি বলেন, “হোটেলের সবাই জানে পাখিদের খাবার দিতে হয়। আমি না থাকলেও বলে রাখি।”
মমতা হোটেলের কর্মচারী ফরিদ হোসেন বলেন, “আমি ১৬ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। গত ৯ বছর ধরে আলী ভাই পাখিদের খাওয়াচ্ছেন। আগে পাখি কম আসলেও এখন অনেক বেড়েছে। শীতকালে সংখ্যা আরও বাড়ে।”
এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন কোটচাঁদপুর উপজেলার বন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামও। তিনি বলেন, “আমি একদিন গিয়েছিলাম পাখিগুলো দেখতে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো একটি উদ্যোগ। তবে কেউ যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এমন কিছু করেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পাখিদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে মোহাম্মদ আলী শেখের এই কাজ এখন পুরো এলাকাজুড়ে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে।