1. info@www.media71bd.com : NEWS TV : NEWS TV
  2. info@www.media71bd.com : TV :
বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৪ পূর্বাহ্ন

বিক্রেত্রী

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক
  • Update Time : শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

আপনি ভাবতেও পারবেন না, বিপণনে আমি কতটা পারদর্শী। আমাকে দশ মিনিট দিন—আমি আমার তরি-তরকারি বা ফল বিক্রি করে ছাড়ব, সেটা আপনার দরকার না হলেও।

নোমানের সঙ্গে ডিভোর্সের পর শুরু করেছিলাম “আয়শা সবজিঘর”—অর্গানিক শাকসবজি ও ফলমূলের দোকান। চাষির কাছ থেকে কেমিক্যাল ফ্রি পণ্য এনে বিক্রি করি। দামি নয়, কিন্তু মানুষের আস্থা পেয়েছি। লাভ কম হলেও আমি আশাবাদী। অসুস্থ পৃথিবীকে স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে সুস্থ করা, আর তাতে মা ও আমার সংসার—এই নিয়েই এখন আমার জীবন।

প্রতিদিনের মতো আজও এলেন সেই বয়স্ক ভদ্রলোক—বশির সাহেব। আমি এগিয়ে গিয়ে বলি,
“শুভ সকাল স্যার, জানেন তো—একমাত্র আয়শা সবজিঘরই দিচ্ছে সম্পূর্ণ কেমিক্যাল ফ্রি ভেজিটেবলস!”

তিনি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিই,
“স্যার, আপনি হয়তো ক্লান্ত—এক কাপ অর্গানিক চা দিই?”

চায়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
“সবজিগুলো সব অর্গানিক?”
“হানড্রেড পারসেন্ট, স্যার! নিজস্ব খামারের।”
“পেঁপে হবে?”
“অবশ্যই, তবে আপনার যদি গ্যাস্ট্রিক সমস্যা থাকে তাহলে থানকুনির পাতা আরও উপকারী। আমি নিয়মিত সাপ্লাই দিতে পারি।”

তিনি কিছু বলেন না—চুপচাপ চায়ে চুমুক দেন।

রাতে স্বপ্নে দেখি নোমানকে। কেমন আছে সে? আমার দেওয়া শার্টটা পরে কি? ওর নতুন স্ত্রী কি আমার মতোই আদর করে? সকালে কি নাশতা বানায় ওর জন্য? ঘাড়ের রগটা কি এখনও তেমনই টান টান?

বশির সাহেবের বয়স ষাট পেরোলেও তিনি অদ্ভুত পরিপাটি। ভরাট গলায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। এমন পরিচ্ছন্ন মানুষ আমি দেখিনি।

একদিন ঝুমবৃষ্টির দুপুরে মন খারাপ ছিল—কারণ নোমান। দোকানের পাশে ছোট্ট চায়ের জায়গা করেছি—“একচিলতে চায়ের আড্ডা”। বৃষ্টি ভিজে এসে বশির সাহেব বসলেন সেখানে। হোম সার্ভিসের প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হলেন না। যথারীতি চায়ের কাপ ঠান্ডা করলেন, আমি সুযোগ বুঝে কিছু পচা সবজিও গছিয়ে দিলাম।

তার কিছুদিন পর বড়সড় হোটেলের মালিক হালিম সাহেব আমার সঙ্গে চুক্তি করলেন—তার হোটেলের সব সবজি এখন থেকে আমার দোকান থেকেই যাবে। সেদিন মনে হয়েছিল, আমি জয়ী।

বশির সাহেব নিয়মিত আসেন, চা খান, বাজার করেন, প্রায়ই ভুলে এক হাজার টাকা বেশি দিয়ে যান। আমি না বোঝার ভান করি—বড়লোক মানুষ, তাতে কী! মাঝে মাঝে বিরক্ত হই, কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় অদ্ভুত শান্তি। তিনি কি একা থাকেন? কারও জন্য এমন অপেক্ষা কেন করেন প্রতিদিন?

সময়ের সঙ্গে দোকান বড় হয়, বিক্রি বাড়ে, ব্যাংক হিসাবও ফুলে ওঠে। ব্যাংকের ম্যানেজার আসিফ সাহেব সহজশর্তে নারী উদ্যোক্তা ঋণ দেন। দুইটা আউটলেট, অসীম ব্যস্ততা—শ্বাস নেওয়ার সময়ও পাই না।

তবু বশির সাহেব প্রতিদিন আসেন—একইভাবে চা খান, নির্বাক দৃষ্টিতে তাকান আমার দিকে, তারপর চলে যান। এখন তার সঙ্গে গল্প করার সময় নেই আমার। তিনি যেমন নির্বিকার, আমি তেমন ব্যস্ত।

একদিন এলেন ভিন্নভাবে—“একচিলতে চায়ের আড্ডা”-য় বসলেন, দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর ভরাট গলায় বললেন,
“আয়শা, একটু বসো।”

তারপর আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। আমি চুপ। মনে হলো পৃথিবী থেমে গেছে। মনে হচ্ছিল, আমি নোমানের বুকে মাথা রাখছি—না কি বাবার? কে তিনি আমার কাছে? প্রশ্নের ভেতর ডুবে গেলাম, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল চারপাশ।

এরপর তিনি আর আসেননি।

কিছুদিন পর জানতে পারলাম—বশির সাহেব মারা গেছেন। শুনে এক অজানা টানে তার বাড়িতে ছুটে গেলাম। বিশাল ভিড়, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কোথাও থেকে। গেটে টাঙানো ছবিতে দেখি—একজন মা ও তার অষ্টাদশী কন্যা, দুজনের চেহারাই আমার মতো! নিচে লেখা মিসেস বশির ও মেয়ে আশা বশির, মৃত্যুর তারিখ—কয়েক বছর আগের।

আমি হতবাক। আমি কে? মা নাকি মেয়ে?

সম্বিত ফিরল ব্যাংক ম্যানেজার আসিফ আর হোটেল মালিক হালিম সাহেবের কথায়,
“আয়শা, পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে বশির সাহেবের ডেড বডি—দেখবেন না?”

সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

রাত গভীর। ঘুম নেই। মনে পড়ছে শেষ দেখা সেই দিনটা। আমি জানি না, বশির সাহেব আমার কাছে কী ছিলেন—অথবা আমি তার কাছে কী। শুধু ভাবি—আমি কি বিক্রি করতে করতে নিজেকেই বিক্রি করে ফেলেছি? আমার জীবন, ভালোবাসা, সংসার—সব কি বিপণনের হাতেই হারিয়ে গেছে?

এই নিঃস্তব্ধ রাতে কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে একটি কাক—আমার সমস্ত ব্যস্ত পৃথিবীর উপরে যেন এক চূড়ান্ত বিদ্রূপ।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি

ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট
error: Content is protected !!