
পণ্য সভ্যতার বিকট থাবা থেকে মুক্তি নেই নারীর। প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি করতে নারীকে পণ্য করে তোলা হচ্ছে— সাবান, শ্যাম্পু, লোমনাশক ক্রিম, আরও কত কিছু। নির্দিষ্ট মাপ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে নারীর জন্য— স্তনে কত ইঞ্চি, নিতম্বে কত, কোমরে কত। নির্ধারিত ছাঁচে না পড়লে তুমি সুন্দরী নও। এই মাপকাঠি মেনে চলতে গিয়ে মেয়েরা ডায়েটিং করে, না খেয়ে থাকে, জিমে ছুটে যায়। পশ্চিমে এমন অসংখ্য মেয়ে ওভার ডায়েটিংয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, তবু এই অন্ধ অনুকরণ থামছে না।
পার্লার থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েরা যেন একই ছাঁচে গড়া— হাঁটা, বসা, কথা বলা এক রকম। মিডিয়া এই সংস্কৃতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। মিডিয়া যতটা নারীবান্ধব দাবি করে, বাস্তবে ততটাই বাণিজ্যিক। পুঁজির প্রভু মিডিয়া সেই জিনিসকেই বিক্রি করে যা সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি লাভ দেয়। নারীদেহ তার সবচেয়ে কার্যকর পণ্য। ফলে মেধাবী নারীর চেয়ে অমেধাবী, খোলামেলা হতে ইচ্ছুক নারীরাই মিডিয়ায় দ্রুত তারকা হয়ে ওঠে।
“সাহসী মেয়ে”— মিডিয়ার এই পরিভাষা এখন শরীর প্রদর্শনের সঙ্গে যুক্ত। একজন মেধাবী, পরিশ্রমী মেয়ের চেয়ে গা খোলা, দেহনির্ভর মেয়েকেই সাহসী বলা হয়। তারা নিজেদের অর্ধনগ্ন ছবি তুলে ভাবে— এটাই স্বাধীনতা। অথচ স্বাধীনতা মানে দেহ খোলা নয়, নিজের প্রতি সম্মানবোধ বজায় রাখা। প্রকৃত নারীবাদ শেখায়, নারী বলতে বোঝায় মানুষ— পণ্য নয়, ভোগ্য বস্তু নয়।
কর্পোরেট পুঁজিবাদ আজ নতুন যৌনদাসী তৈরি করছে— নাম দিচ্ছে বিউটি হান্ট, মডেল সার্চ, ট্যালেন্ট শো। ভেতরে ব্যবসা, বাইরে সৌন্দর্যের মুখোশ। আধুনিক দাসত্বকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে গ্ল্যামারের মোড়কে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে প্রতিযোগীদের শরীরের প্রতিটি অংশের মাপ দিতে হয়। ৩৬-২৬-৩৬ ইঞ্চির বাইরে কোনো মেয়েই ‘আদর্শ সুন্দরী’ নয়। সভ্যতার অগ্রগতির পরও আধা উলঙ্গ হয়ে মঞ্চে হাঁটতে হয়, পুরুষতন্ত্রের নির্ধারিত মাপকাঠি মেনে চলতে হয়।
‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’-এর মতো প্রতিযোগিতায় কয়েক হাজার তরুণী অংশ নেয়, মাত্র একজন পায় মুকুট। বাকিদের পরিণতি কেউ জানে না। আবেদনপত্রে উচ্চতা, ওজন, কোমর, নিতম্ব, স্তনের মাপ দিতে হয়। এর চেয়ে প্রকাশ্য শরীরবাজার আর কী হতে পারে! আরও দুঃখজনক হলো, অভিভাবকরাও এতে সহযোগিতা করেন— বিচারকদের হাতে মেয়েদের দেহের বিবরণ তুলে দেন, সমাজ তা উপভোগ করে।
মিডিয়া সুন্দরকে অসুন্দর আর অসুন্দরকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে ওস্তাদ। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় একজন বিজয়ীর সাফল্য ফলাও করে দেখায়, কিন্তু যে হাজারো মেয়ের সম্মান, আত্মমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের গল্প আড়াল করে রাখে।
মানুষের সৌন্দর্য তার গায়ের রঙে বা শরীরের মাপে নয়। সৌন্দর্য হলো সৃষ্টিকর্তার বৈচিত্র্য— প্রতিটি মানুষই অনন্য, প্রতিটি মানুষই সুন্দর। এই সৌন্দর্যে নিজের কোনো অর্জন নেই, তাই তা নিয়ে প্রতিযোগিতারও কিছু নেই। নারী এগিয়ে আসুক জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও মানবিকতার মঞ্চে— কাপড় খুলে নয়, কাপড় পরে; মাথা উঁচু করে, সম্মানের সঙ্গে।
সভ্য দুনিয়ার প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত মেধা, কাজ ও মানবিকতায়— দেহে নয়। নারীকে মুক্ত হতে হবে কর্পোরেট পণ্যের খাঁচা থেকে, ফিরে যেতে হবে নিজের আসল পরিচয়ে— মানুষ হিসেবে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি
Leave a Reply